بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১৯/এবং কাফির রা বলে -৯) [ * *ইসলামে নেতৃত্ব ও তার অভিন্ন জীবন ব্যবস্থা :-   *ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ড :- **’তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তাে শেষ:-] www.motaher21.net সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া পারা:২৫ ১৬-৩০ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১৯/এবং কাফির রা বলে -৯)
[ * *ইসলামে নেতৃত্ব ও তার অভিন্ন জীবন ব্যবস্থা :-
*ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ড :-
**’তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তাে শেষ:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া পারা:২৫
১৬-৩০ নং আয়াত:-
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৬
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحُکۡمَ وَ النُّبُوَّۃَ وَ رَزَقۡنٰہُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰہُمۡ عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۚ۱۶﴾
ইতিপূর্বে আমি বনী ইসরাঈলদের কিতাব, হুকুম ও নবুওয়াত দান করেছিলাম। আমি তাদেরকে উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলাম, সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর মর্যাদা দান করেছিলাম।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৭
وَ اٰتَیۡنٰہُمۡ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡاَمۡرِ ۚ فَمَا اخۡتَلَفُوۡۤا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ ۙ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ ؕ اِنَّ رَبَّکَ یَقۡضِیۡ بَیۡنَہُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ فِیۡمَا کَانُوۡا فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ﴿۱۷﴾
এবং দ্বীনের ব্যাপারে স্পষ্ট হিদায়াত দান করেছিলাম। অতঃপর তাদের মধ্যে যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিলো তা (অজ্ঞতার কারণে নয়, বরং) জ্ঞান আসার পরে হয়েছিলো এবং এ কারণে হয়েছিলো যে, তারা একে অপরের ওপর জুলুম করতে চাচ্ছিলো। তারা যেসব ব্যাপারে মতভেদ করে আসছিলো আল্লাহ‌ কিয়ামতের দিন সেই সব ব্যাপারে ফায়সালা করবেন।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৮
ثُمَّ جَعَلۡنٰکَ عَلٰی شَرِیۡعَۃٍ مِّنَ الۡاَمۡرِ فَاتَّبِعۡہَا وَ لَا تَتَّبِعۡ اَہۡوَآءَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۸﴾
অতঃপর হে নবী, আমি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাকে একটি সুস্পষ্ট রাজপথের (শরীয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং তুমি তার ওপরেই চলো এবং যারা জানে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৯
اِنَّہُمۡ لَنۡ یُّغۡنُوۡا عَنۡکَ مِنَ اللّٰہِ شَیۡئًا ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ۚ وَ اللّٰہُ وَلِیُّ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۱۹﴾
আল্লাহর মোকাবিলায় তারা কোন কাজেই আসতে পারে না। জালেমরা একে অপরের বন্ধু এবং মুত্তাকীনদের বন্ধু আল্লাহ।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২০
ہٰذَا بَصَآئِرُ لِلنَّاسِ وَ ہُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ ﴿۲۰﴾
এ কুরআন মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা এবং হেদায়াত ও রহমত এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা নিশ্চিত বিশ্বাস করে।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২১
اَمۡ حَسِبَ الَّذِیۡنَ اجۡتَرَحُوا السَّیِّاٰتِ اَنۡ نَّجۡعَلَہُمۡ کَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ۙ سَوَآءً مَّحۡیَاہُمۡ وَ مَمَاتُہُمۡ ؕ سَآءَ مَا یَحۡکُمُوۡنَ ﴿٪۲۱﴾
যেসব লোক অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে এবং মু’মিন ও সৎকর্মশীলদেরকে সমপর্যায়ভুক্ত করে দেবো যে তাদের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? তারা যে ফায়সালা করে তা অত্যন্ত জঘণ্য।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২২
وَ خَلَقَ اللّٰہُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ وَ لِتُجۡزٰی کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا کَسَبَتۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲﴾
আল্লাহ যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; যাতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কর্মানুযায়ী ফল দেওয়া যেতে পারে। আর তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৩
اَفَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ وَ اَضَلَّہُ اللّٰہُ عَلٰی عِلۡمٍ وَّ خَتَمَ عَلٰی سَمۡعِہٖ وَ قَلۡبِہٖ وَ جَعَلَ عَلٰی بَصَرِہٖ غِشٰوَۃً ؕ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡہِ مِنۡۢ بَعۡدِ اللّٰہِ ؕ اَفَلَا تَذَکَّرُوۡنَ ﴿۲۳﴾
তবে কি আপনি লক্ষ্য করেছেন তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজ ইলাহ্‌ বানিয়ে নিয়েছে? আর তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তিনি তার কান ও হৃদয়ে মোহর করে দিয়েছেন। আর তিনি তার চোখের উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পরে কে তাকে হেদায়েত দিবে? তবু কি তোমরা উপদেশ গ্ৰহণ করবে না?
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৪
وَ قَالُوۡا مَا ہِیَ اِلَّا حَیَاتُنَا الدُّنۡیَا نَمُوۡتُ وَ نَحۡیَا وَ مَا یُہۡلِکُنَاۤ اِلَّا الدَّہۡرُ ۚ وَ مَا لَہُمۡ بِذٰلِکَ مِنۡ عِلۡمٍ ۚ اِنۡ ہُمۡ اِلَّا یَظُنُّوۡنَ ﴿۲۴﴾
এরা বলেঃ জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এই জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদের ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোন জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে এসব কথা বলে।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৫
وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُنَا بَیِّنٰتٍ مَّا کَانَ حُجَّتَہُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوا ائۡتُوۡا بِاٰبَآئِنَاۤ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۲۵﴾
ওদের নিকট যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হয় তখন কেবল এ উক্তি ছাড়া ওদের কোন যুক্তি থাকে না যে, ‘তোমরা সত্যবাদী হলে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে উপস্থিত কর।’
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৬
قُلِ اللّٰہُ یُحۡیِیۡکُمۡ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یَجۡمَعُکُمۡ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٪۲۶﴾
বলুন, ‘আল্লাহই তোমাদেরকে জীবন দান করেন তারপর তোমাদের মৃত্যু ঘটান। তারপর তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের দিনে একত্র করবেন, যাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষ তা জানে না।’
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৭
وَ لِلّٰہِ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یَوۡمَئِذٍ یَّخۡسَرُ الۡمُبۡطِلُوۡنَ ﴿۲۷﴾
যমীন এবং আসমানের বাদশাহী আল্লাহর। আর যেদিন কিয়ামতের সময় এসে উপস্থিত হবে সেদিন বাতিলপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৮
وَ تَرٰی کُلَّ اُمَّۃٍ جَاثِیَۃً ۟ کُلُّ اُمَّۃٍ تُدۡعٰۤی اِلٰی کِتٰبِہَا ؕ اَلۡیَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۸﴾
সে সময় তোমরা প্রত্যেক গোষ্ঠীকে নতজানু দেখতে পাবে। প্রত্যেক গোষ্ঠীকে এসে তার আমলনামা দেখার জন্য আহবান জানানো হবে। তাদের বলা হবে, তোমরা যেসব কাজ করে এসেছো তোমাদেরকে তার প্রতিদান দেয়া হবে।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২৯
ہٰذَا کِتٰبُنَا یَنۡطِقُ عَلَیۡکُمۡ بِالۡحَقِّ ؕ اِنَّا کُنَّا نَسۡتَنۡسِخُ مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۹﴾
এটা আমার তৈরী করানো আমলনামা, যা তোমাদের বিরুদ্ধে ঠিক ঠিক সাক্ষ্য দিচ্ছে। তোমরা যাই করতে আমি তাই লিপিবদ্ধ করাতাম।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৩০
فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَیُدۡخِلُہُمۡ رَبُّہُمۡ فِیۡ رَحۡمَتِہٖ ؕ ذٰلِکَ ہُوَ الۡفَوۡزُ الۡمُبِیۡنُ ﴿۳۰﴾
যারা ঈমান এনেছিলো এবং সৎকাজ করেছিল তাদের রব তাদেরকে তাঁর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করাবেন। এটা সুস্পষ্ট সাফল্য।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*ইসলামে নেতৃত্ব ও তার অভিন্ন জীবন ব্যবস্থা : এরপর মানবতার জন্যে ঈমানী আদর্শে বলীয়ান নেতৃত্বের আলােচনা করা হচ্ছে এবং পরিশেষে এই নেতৃত্বের ভিত্তি ইসলামী আদর্শের ওপরই রাখা হয়েছে। বনী ইসরাঈলের মতবিরােধের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব, শাসন ক্ষমতা ও নবুওত লাভের পর তারা এই মতবিরােধে লিপ্ত হয়েছে। ফলে নেতৃত্ব ও শাসনের ঝান্ডাও সর্বশেষ নবীর হাতে অর্পণ করা হয়। অথচ তিনি তখনও মক্কায়ই রয়েছেন এবং এখনও তিনি বিরােধিতা ও প্রতিরােধের মুখেই রয়েছেন। এর দ্বারা যে বিষয়টি বুঝানাে হয়েছে, তা হলাে ইসলামী দাওয়াতের প্রকৃতি সকল যুগেই এক ছিলো এবং নবী রসূলদের দায়িত্বও সকল যুগে একছিলাে। তাই বলা হয়েছে, ‘আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে পরিচ্ছন্ন রিযিক নিয়ে…’(আয়াত ১৬-২০) রসূলুল্লাহ(স.)-এর আগমনের পূর্বে নেতৃত্ব ছিলাে বনী ইসরাঈলদের হাতে। তখনকার যুগে ঐশী মতাদর্শের ধারক বাহক তারাই ছিলাে। এই আদর্শ ছিলাে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। কাজেই এই মতাদর্শের অনুসরণ ব্যতীত মানুষের অন্য কোনাে উপায় নেই। কারণ, পৃথিবীর বুকে যে নেতৃত্ব চলছিলাে তা সম্পূর্ণ মনগড়া, ভ্রান্ত ও অসম্পূর্ণ। যেহেতু আল্লাহ তায়ালাই মানুষের সৃষ্টিকর্তা, কাজে মানুষের উপযোগী জীবন বিধান একমাত্র তিনিই দিতে পারেন। একমাত্র তিনিই দিতে পারেন মানবীয় অজ্ঞতা, দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতার উর্ধের জীবনবিধান। তিনিই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তাদের সম্পর্কে ভাল জানেন। আলােচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওত দান করে ছিলাম…’ অর্থাৎ জীবন বিধান হিসেবে তাদেরকে তাওরাত দান করেছিলাম। এই জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তাদেরকে রাজত্ব দান করেছিলাম, মূসা(আ.)-এর পর থেকে নুওতের ঝান্ডা তাদের হাতেই ছিলাে। দীর্ঘকাল ধরে নবুওত তাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলাে। এরপর বলা হয়েছে, ‘আমি তাদেরকে পরিচ্ছন্ন রিযিক দান করেছিলাম…’ অর্থাৎ নীল নদ ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী যে এলাকায় তারা রাজত্ব করতাে সে এলাকা ছিলাে উর্বর ও পবিত্র। সেখানে প্রচুর পরিমাণে ফলমূল ও বিভিন্ন শস্যাদি উৎপন্ন হতাে। এরপর বলা হয়েছে, ‘আমি তাদেরকে বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম…।’ অর্থাৎ তৎকালীন যুগের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের মাঝে তারা শ্রেষ্ঠ ছিলাে। কারণ তাদের হাতে ছিলাে নবুওত ও নেতৃত্বের ঝান্ডা। আল্লাহর শরীয়ত কায়েম করার দায়িত্ব ছিলাে তাদের হাতেই। এই হিসেবে তারা অন্যান্যদের তুলনায় নিসন্দেহে শ্রেষ্ঠ ছিলাে, বেশী মর্যাদার অধিকারী ছিলাে। এরপর বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে দ্বীনের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দিয়ে ছিলাম…’ অর্থাৎ তাদেরকে যে শরীয়ত দান করা হয়েছিলাে তা ছিলাে চুড়ান্ত ও সুস্পষ্ট। তাতে কোনাে অস্পষ্টতা ছিলাে না, কোনাে বক্রতা ছিলাে না এবং কোনাে ত্রুটি বিচ্যুতি ছিলাে না। এই জাতীয় সুস্পষ্ট একটি বিষয়ে তাদের মতবিরােধ করার কোনাে কারণ ছিলাে না, অথচ তারা মতবিরোধ করেছে; আর এই মতবিরােধ কোনাে অস্পষ্টতার কারণে হয়নি এবং কোনাে অজ্ঞতার কারণেও হয়নি। বরং জেনে বুঝে তারা এই মতবিরােধ করেছে। তাই বলা হয়েছে, ‘অতপর তারা জ্ঞান লাভ করার পর শুধু পারস্পরিক জেদের বশবর্তী হয়ে মতভেদ সৃষ্টি করে…’ অর্থাৎ তারা পরস্পর শত্রুতা, হিংসা বিদ্বেষের কারণে জেনে বুঝে এই মতবিরােধে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের হাত থেকে নবুওত ও নেতৃত্বের ঝান্ডা ছিনিয়ে নেয়া হয়। তাদের ফয়সালা আল্লাহর হাতে চলে যাক, পরকালে তিনিই তাদের বিচার করবেন। তাই বলা হয়েছে, ‘তারা যে বিষয়ে মতভেদ করতাে, তােমার পালনকর্তা কেয়ামতের দিন তার ফয়সালা করে দেবেন।’ এরপর আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর বুকে নবুওত ও নেতৃত্বের জন্যে নতুন নবী নির্বাচিত করেন। যে নবী আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ও শরীয়ত অনুযায়ী মানব সমাজের নেতৃত্ব দেবেন। এখানে তার ব্যক্তিগত খেয়াল খুশীর কোনাে সুযােগ থাকবে না। তাই বলা হয়েছে, এরপর আমি তােমাকে রেখেছি দ্বীনের এক বিশেষ শরীয়তের ওপর…'(আয়াত ১৮) অর্থাৎ দুটোর যে কোনাে একটি হবে। হয় আল্লাহর শরীয়ত বা বিধান মােতাবেক জীবন চলবে। অথবা ব্যক্তির খেয়াল খুশীমতাে তা চলবে। তৃতীয় কোনাে পন্থা নেই, শরীয়ত ও মানুষের খেয়াল খুশীর মধ্যবর্তী কোনাে পন্থা নেই। যদি কেউ আল্লাহর শরীয়তকে ত্যাগ করে তাহলে বুঝতে হবে যে, সে দ্বীন থেকে বের হয়ে গেছে। কেননা ব্যক্তিগত খেয়াল খুশীমতাে বাইরে যা কিছু আছে তা সবই মনগড়া ও অজ্ঞতাপূর্ণ। এখানে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে অজ্ঞ লােকদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ না করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। কারণ, তারা কেউ তাকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তারা একে অপরের সহযােগী। কিন্তু তারপরও তারা তার কোনােই ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন তাঁর বন্ধু ও সহায়ক। তাই বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহর সামনে তারা কেউ তােমার কোনাে উপকারে আসবে না…।'(আয়াত ১৯) এই আয়াত এবং এর আগের আয়াতে যা বলা হয়েছে, তা ইসলামী দাওয়াতের মশালবাহীদের পথনির্দশনা করছে। এখানে যা কিছু বলা হয়েছে, তারপর আর কিছু বলার প্রয়ােজন থাকে না। অর্থাৎ আল্লাহর শরীয়ত এক ও অভিন্ন। মানবজাতির জন্যে এই শরীয়তই একমাত্র মনােনীত জীবন বিধান। এর বাইরে যা কিছু আছে তা সবই মনগড়া, যার উৎস হচ্ছে অজ্ঞতা। কাজেই যারা ইসলামী দাওয়াতের ধারক ও বাহক তারা এক মাত্র আল্লাহর শরীয়তেরই অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য সকল মনগড়া মতবাদ আদর্শ ত্যাগ করবে। তারা যেন কখনও এই শরীয়ত থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য কোনাে মতবাদের অনুসরণ না করে। কারণ যারা এসব মনগড়া মতবাদের স্রষ্টা ও ধারক, তাদের কেউ আল্লাহর হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। তবে তারা আল্লাহর শরীয়তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। কাজেই তাদের কাছ থেকে সাহায্য সহযােগিতা আশা করা বাতুলতা মাত্র। তারা কারাে কোনাে ক্ষতিও করতে পারবে না। কারণ, যারা আল্লাহর দ্বীনের ওপর টিকে থাকবে তাদেরকে আল্লাহই রক্ষা করবেন। আল্লাহর সামনে অন্য কারাে কোনাে ক্ষমতা নেই। এরপর বলা হয়েছে, ‘এটা মানুষের জন্যে জ্ঞানের কথা এবং বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে হেদায়াত ও রহমত।'(আয়াত ২০) এখানে পবিত্র কোরআনকে জ্ঞানের কথা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে মানুষ চলার পথ খুঁজে পায়, আঁধারে আলাের সন্ধান পায়। এই কোরআন হেদায়াত ও রহমতের ভান্ডার। এই ভান্ডার থেকে কেবল তারাই লাভবান হতে পারে যাদের মনে বিশ্বাস রয়েছে, ঈমান রয়েছে, আস্থা রয়েছে যাদের মনে কোনাে সংশয় সন্দেহ নেই এবং কোনাে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই। মনে যখন বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, আস্থার সৃষ্টি হয় তখন মানুষ নিজের চলার পথ খুঁজে পায় এবং পথে চলতে গিয়ে কোনাে হোঁচট খায় না, পা টলে না, লক্ষ্যচ্যুত হয় না। কারণ তখন তার চোখের সামনে রাস্তা থাকে পরিস্কার, দিগন্ত থাকে উজ্জ্বল, লক্ষ্য থাকে সুস্পষ্ট, আর সে কারণেই পবিত্র কুরআন তার জন্যে হয় হেদায়াত ও আলোর দিশারী।
*ন্যায় ও অন্যায়ের মানদন্ড : উপরের আলােচনায় আমরা জানতে পারলাম, কাফের ও আল্লাহদ্রোহী লােকেরা পরস্পর বন্ধু ও সহযােগী। অপরদিকে যারা ধর্মপ্রাণ ও ঈমানদার, তাদের অভিভাবক ও সহায়ক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। আমরা আরও জানতে পেলাম যে, কোরআন কেবল এই ঈমানদার লোকদের জন্যেই জ্ঞান, হেদায়াত ও রহমতের উৎস। এই আলোচনার পর এখন ধার্মিক ও অধার্মিক এবং সৎ ও অসৎ লােকদের পার্থক্য তুলে ধরা হচ্ছে। এই উভয় শ্রেণী যে আল্লাহর মানদন্ডে কখনও সমান হতে পারে না সে কথা বলা হয়েছে। কারণ আল্লাহ তায়ালা ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে এই জগত সৃষ্টি করেছেন। তাই জগত সৃষ্টির বুনিয়াদই হচ্ছে ন্যায় ও সত্য। কাজেই তিনি ন্যায় ও অন্যায় এবং সৎ ও অসৎকে একই পর্যায়ে রাখতে পারেন না। আয়াতে সে কথা বলা হয়েছে, ‘যারা দুর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সেই লােকদের মতাে করে দেবাে, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু সমান হবে? তাদের দাবী কতাে মন্দ…।'(আয়াত ২১-২২) আলােচ্য আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে তারা হয়তাে ঐশী গ্রন্থের অনুসারী সম্প্রদায়ভুক্ত। অর্থাৎ ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী লােকজন। এরা ঐশী গ্রন্থের অনুশাসন অমান্য করে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরও নিজেদের ধার্মিক ও ঈমানদার মনে করতে থাকে, নিজেদের সৎলােকদের সমপর্যায়ের মনে করতে থাকে। এদের বিশ্বাস যে ইহকাল ও পরকালে তাদের অবস্থা ধার্মিক ও সৎলােকদের মতােই হবে। আলােচ্য আয়াতের আর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, এখানে সাধারণভাবে সবার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর বিচারে সকল যুগের সৎ ও অসৎ এবং ধার্মিক ও অধার্মিক কেমন হবে সে কথা বলা হয়েছে। এই হিসেবে বলা যায় যে, আল্লাহর মানদন্ডে ধার্মিক ও অধার্মিক এবং সৎ ও অসৎ লােকেরা কখনও এক হতে পারে না। ইহকালেও না এবং পরকালেও না। কারণ এমনটি করা হলে সেটা হবে ন্যায় বিরােধী, সত্যের বিরােধী। অথচ এই ন্যায় ও সত্যের ওপর ভিত্তি করেই গােটা জীবন ও জগত টিকে আছে। এই ন্যায় ও সত্যের দাবী হচ্ছে, সৎ ও অসৎ এবং ধার্মিক ও অধার্মিকদের মাঝে পার্থক্য করা, তাদেরকে এক দলভূক্ত মনে না করা। উভয় শ্রেণীর প্রত্যেককে যার যার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া এবং কোনাে প্রকার অবিচার না করা। সত্য ও ন্যায়ের এই মূলনীতির কথা পবিত্র কোরআনে বারবার বলা হয়েছে। কারণ এটা ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের মূল ভিত্তি এবং এর ওপরই ভিত্তি করে এই আকিদা বিশ্বাস সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়, জীবন ও জগত সংক্রান্ত বিষয় দাড়িয়ে আছে। এই শাশ্বত ও চিরন্তন মূলনীতির পাশাপাশি মানুষের অস্থির চিত্তের প্রসংগ আলােচিত হচ্ছে। এই অস্থির চিত্তের খেয়াল খুশীকে অনেকেই দেবতার মর্যাদা দিয়ে থাকে। ফলে তারা সঠিক পথ থেকে দূরে সরে পড়ে এবং কখনও তাদের ভাগ্যে হেদায়াত জোটেনা। তাই বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছো যে তার খেয়াল খুশীকে স্বীয় মাবুদ সাব্যস্ত স্থির | করেছে…'(আয়াত ২৩) এখানে অপূর্ব বর্ণনাভংগির মাধ্যমে পবিত্র কোরআন শাশ্বত মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর মানব মনের অবস্থা চিত্রায়িত করছে। আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন এই শাশ্বত মূলনীতি ত্যাগ করে নিজের খেয়াল খুশীর দাসত্বে লিপ্ত হয়ে তখন সে তার আচার আচরণ, চিন্তা-চেতনা এবং অনুরাগ অনুভূতি এই অস্থির চিত্তের খেয়াল খুশীরই অধীন হয়ে পড়ে। তার গােটা সত্ত্বা এই প্রভুর আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে। তাই বিস্ময়মাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘তুমি কি সেই লােককে দেখেছো, যে নিজের খেয়াল খুশীকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে…’ অর্থাৎ এই আজব ও অদ্ভুত মানুষটিকে দেখেছাে কি? এমন মানুষ কখনও হেদায়াত লাভ করতে পারে না, আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে না। হেদায়াতকে স্থান দেয়ার মতে হৃদয় তার মাঝে নেই। সে তাে রােগাক্রান্ত ও অস্থির চিত্তের আজ্ঞাবহ দাস। তাই বলা হয়েছে, আল্লাহ জেনেই তাকে গােমরাহ করেছেন, পথভ্রষ্ট করেছেন। অথবা তিনি সঠিক অবস্থা জানার পর তাকে খেয়াল খুশীমতাে চলা থেকে বিরত রাখেননি। এটাও এক ধরনের বিপথগামিতা। এই বিপথগামিতার উপযুক্ত বলেই আল্লাহ তায়ালা তার সাথে এই আচরণ করেছেন, ‘তার কান ও অন্তরে মােহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের ওপর পর্দা রেখেছেন। এর ফলে তার হৃদয়ে আলাে প্রবেশের সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। চিন্তা ভাবনার সকল শক্তি লােপ পেয়েছে আর সে কারণেই সে নিজ খেয়াল খুশীর দাসে পরিণত হয়ে পড়েছে। ‘এমন লােককে আল্লাহর পর আর কে পথ দেখাতে পারে…’ কারণ হেদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি ব্যতীত আর কেউ হেদায়াত ও গােমরাহীর মালিক নয়। এমনকি তার মনােনীত রসূলরাও নন। এটা একান্তই তার ব্যাপার। এরপর বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি চিন্তা ভাবনা করো না…’ কারণ যারা চিন্তা ভাবনা করে তারা সতর্ক হয়, সজাগ হয়। প্রবৃত্তির দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত হয় এবং সুস্থির ও সুস্পষ্ট নীতির অনুসারী হয়, এর ফলে কখনও লক্ষ্যচ্যুত হয় না।
** ‘তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তাে শেষ, আমরা মরি ও বাঁচি…।'(আয়াত ২৪-২৭) আলােচ্য সূরায় এই শেষ পর্বে পরকাল, পুনর্জন্ম ও পুনরুত্থান সম্পর্কে মােশরেকদের মন্তব্য উল্লেখ করে তাদের সৃষ্টি রহস্যের আলােকেই এর উত্তর দেয়া হয়েছে। কারণ, মানব সৃষ্টি রহস্য তাদের চোখের সামনেই রয়েছে। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। এরপর কেয়ামতের দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং কেয়ামতের দিন তাদের কী অবস্থা দাঁড়াবে এর একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যদিও কেয়ামত এখনও আসেনি। কিন্তু কোরআন তার নিজস্ব বর্ণনাভংগির মাধ্যমে সেটাকে দৃশ্যমান ও মূর্ত করে তুলেছে যেন গােটা দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। সূরার সমাপ্তি ঘটেছে আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে। তার তাওহীদ ঘােষণার মাধ্যমে, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহত্মা বর্ণনার মাধ্যমে এবং তাঁর অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বর্ণনার মাধ্যমে। *জীবন মৃত্যু ও পুনরুত্থান সম্পর্কিত দৃষ্টিভংগি : আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবন তো শেষ…'(আয়াত ২৪-২৬) এই হচ্ছে ওদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগি। জীবন বলতে তারা এই পার্থিব জীবনটাই বুঝে যা তারা দেখতে পায় এবং উপভােগ করতে পারে। ওরা দেখছে, এক প্রজন্ম আসছে আর এক প্রজন্ম যাচ্ছে। এখানে মৃত্যুর বাহ্যিক অস্তিত্ব ওদের চোখে ধরা পড়ছে না। বরং ওদের বিশ্বাস, কালের পরিক্রমায় একসময় মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। অর্থাৎ কালের পরিক্রমাই ওদের আয়ু নিঃশেষ করে দেয় এবং ওদের দেহের ওপর মৃত্যুকে চাপিয়ে দেয়, ফলে সবার মৃত্যু ঘটে। বলা নিপ্প্রয়ােজন যে, এটা হচ্ছে জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে নিতান্ত অগভীর দৃষ্টিভংগি । এই দৃষ্টিভংগির ফলে মানুষ কখনও জীবনের অন্তর্নিহিত রহস্য উপলব্ধি করতে পারে না। এই শ্রেণীর মানুষ কখনও চিন্তা করে দেখে না যে, এই জীবন তাদের কাছে কিভাবে এবং কোথা থেকে আসলাে এবং এ জীবন তাদের কাছ থেকে কে ছিনিয়ে নেয়? মানুষের মৃত্যু তাে বিশেষ কোনাে নিয়মের অধীনে ঘটে না, নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন পার হলেই ঘটেনা। কাজেই ওরা কি করে বুঝলাে যে, সময়ের ব্যবধানেই মৃত্যু ঘটে? তাহলে অল্প বয়সী শিশুদের মৃত্যু কিভাবে ঘটে? সুস্থ লােকদের মৃত্যু কিভাবে ঘটে? কোন নিয়মেই বা শক্ত সামর্থ্য লােকদের মৃত্যু ঘটে? এতে প্রমাণিত হয় যে, কেবল কালের পরিক্রমাকেই মৃত্যুর কারণ বলে গণ্য করা যায় না। বরং যারা গভীর দৃষ্টিভংগি এবং অনুসন্ধিৎসু মনােভাব নিয়ে জীবন ও মৃত্যুর বিষয়টি তলিয়ে দেখে, এর রহস্য উঘাটন করতে চায় এবং এর প্রকৃত কারণ জানতে চায়, তারা কখনও সেই জাতীয় ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সেই ব্যাপারে ওদের কোনাে জ্ঞান নেই। ওরা তাে নিছক অনুমান করে।” অর্থাৎ ওরা নিছক ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে এসব কথা বলে থাকে। অথচ ওদের এসব অনুমান হচ্ছে নিতান্তই অস্পষ্ট ও ভিত্তিহীন যার সাথে প্রকৃত জ্ঞান ও চিন্তার কোনােই সম্পর্ক নেই। এর দ্বারা বস্তুনিচয়ের প্রকৃত পরিচয়ও পাওয়া যায় না। যারা এ জাতীয় ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে জীবন ও মৃত্যুর ব্যাখ্যা করে তারা কখনও এর অন্তরালে ভিন্ন এক সত্ত্বার ইচ্ছার প্রতিফলনকে দেখতে পায় না এবং কালের পরিক্রমার বাইরে অন্য কোনাে কারণ দেখতে পায়। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাদের কাছে যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়…।'(আয়াত ২৫) এটা হচ্ছে সম্পূর্ণ এক স্থূল দৃষ্টিভংগি। এই দৃষ্টিভংগি যারা পােষণ করে তারাও পূর্বের আয়াতে বর্ণিত লােকদের মতােই সৃষ্টির পেছনে ক্রিয়াশীল আল্লাহর কুদরতকে দেখতে পায় না, জীবন ও মৃত্যুর গােপন রহস্য তারা অনুধাবন করতে পারে না। এই পৃথিবীর বুকে মানুষকে কর্মের সুযােগ হিসেবে জীবন দান করা হয়। মানুষ এই সুযােগের কতােটুকু সদ্ব্যবহার করছে আল্লাহ তায়ালা তা পরীক্ষা করে দেখতে চান। এরপর তাদের মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যুর পর মানুষের কর্মের হিসাব নিকাশের জন্যে নির্ধারিত একটি দিনে সকলকে পুনরায় জীবিত করা হবে। তারপর তাদের হিসাব নিকাশ করা হবে। তাই মানুষ মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আর ফিরে আসবে না। কেউ চাইলেও আসবে না। কারণ এটা আল্লাহর সৃষ্টি বিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। অথচ গােটা সৃষ্টি জগত এই নিয়ম ও বিধান অনুযায়ীই চলছে। কাজেই মৃত ব্যক্তিদেরকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার দাবী নিতান্তই বােকামী। ওদের মৃত পূর্বপুরুষদেরকে আল্লাহ তায়ালা কেন তার নির্ধারিত সময়ের আগে জীবিত করবেন। এর মাধ্যমে ওরা কি মৃতকে পুনরায় জীবিত করার আল্লাহর ক্ষমতার পরীক্ষা করতে চায়? আল্লাহ তায়ালা কি তার সৃষ্টি নিয়ম অনুসারী প্রতি মুহূর্তে তাদের চোখের সামনেই সৃষ্টি করছেন না? তাই বলা হচ্ছে, তুমি বলে দাও, আল্লাহ তায়ালাই অতপর তােমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্রিত করবেন…।'(আয়াত ২৬) এই অলৌকিক ঘটনাই তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে দেখতে চায়। অথচ এই অলৌকিক ঘটনাই প্রতিনিয়ত তাদের চোখের সামনে ঘটছে। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে জীবন দান করেন, এক মাত্র তিনিই তার মৃত্যু ঘটান। যদি তাই হয়, তাহলে তিনি মানুষকে পুনরায় জীবিত করে কেয়ামতের দিন একত্রিত করলে এতে আশ্চর্যের কী আছে? এ ব্যাপারে সংশয় সন্দেহেরও কিছু নেই। কারণ এর নযীরতাে তারা সচক্ষেই দেখছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ। জানতে চায় না, বুঝতে চায় না। এরপর বলা হচ্ছে, ‘আসমান ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই …’ যেহেতু গােটা সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র মালিকানা ও কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর। তাই সব কিছুই তার করায়ত্ত। তিনিই সব কিছুর স্ৰষ্টা এবং তিনিই যে কোনাে কিছু পুনরায় সৃষ্টি করতে পারেন।

*কেয়ামতের ময়দানে কাফের ও মুমিনের অবস্থা : কেয়ামতের দৃশ্য বর্ণনা করে বলা হচ্ছে, ‘যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন বাতিলপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুমি প্রত্যেক উম্মতকে নতজানু অবস্থায় দেখবে…'(আয়াত ২৭-২৮) প্রথম আয়াতেই বাতিল পন্থীদের পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যে দিনটির তুড়িৎ আগমনের জন্যে তারা অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছিলাে আজ সেদিনটিতেই তারা সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আয়াতের বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে আমাদের সামনে যে দৃশ্যটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে তাতে আমরা একটা বিরাট ময়দান দেখতে পাই। সেখানে এই গ্রহের বাসিন্দারা দলে দলে একত্রিত হচ্ছে। তারা একেক দলে বিভক্ত হয়ে নতজানু অবস্থায় ভয়ানক এক হিসাবের অপেক্ষায় বসে আছে। একই ময়দানে এতাে বিরাট সংখ্যক লােকদের সমাগমই এক ভয়ানক দৃশ্যের অবতারণা করবে। তাছাড়া যখন দেখা যাবে, মানুষ দলে দলে নতজানু হয়ে বসা, তখন সে দৃশ্যও মনে ভীতির সৃষ্টি করবে। এরপর রয়েছে হিসাব নিকাশের আতংকময় মুহূর্ত। এর চেয়েও মারাত্মক ও আতঙ্কময় মুহূর্ত হচ্ছে পরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী আল্লাহর সামনে হাযির হওয়ার মুহূর্তটি। এই মহূর্তে সেই সকল লােকেরা উপস্থিত হবে যারা আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামত ভােগ করেছে, কিন্তু কোনােদিন তার করিয়া আদায় করেনি। এই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে অপেক্ষমান জনস্রোতের উদ্দেশ্যে এই ভাষায় ঘােষণা আসবে, ‘আজ তােমাদের কর্মের প্রতিফল দেয়া হবে। আমার কাছে রক্ষিত এই আমলনামা তোমাদের সম্পর্কে সত্য কথা বলবে…।'(আয়াত ২৮-২৯) অর্থাৎ এই আমলনামায় ছােট খাট সব কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কোনাে কিছুই বাদ দেয়া হয়নি অথবা ভুল করা হয়নি। কারণ, সব কিছুই আল্লাহর জ্ঞানের আওতায় রয়েছে। কাজেই তার দৃষ্টির অন্তরালে কোনাে কিছু থাকতে পারে না। তার জ্ঞানের বাইরেও কিছু থাকতে পারে না। এরপর বিভিন্ন জাতি ও গােষ্ঠীর এই বিশাল জনসমুদ্রকে দুটো দলে বিভক্ত করা হবে। একটি দল হবে ঈমানদারদের আর একটি দল হবে কাফেরদের। অর্থাৎ একটি দল হচ্ছে হিযবুল্লাহ’ বা আল্লাহর দল আর অপরটি হচ্ছে হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের দল। কেবল এই দুটো দলের সাথেই যুক্ত হবে উপস্থিত শতধাবিভক্ত জাতি, ধর্ম ও বর্ণের লােকগুলাে। বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে তাদের পালনকতা স্বীয় রহমতে দাখিল করবেন'(আয়াত ৩০) এর ফলে তারা দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবে এবং উদ্বেগ ও উৎকষ্ঠা থেকে রক্ষা পাবে। তাদের ব্যাপারটা খুব দ্রুত সমাধা হয়ে যাবে বলে আলােচা আয়াতের বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে বুঝা যায়।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৬-২০ নং আয়াতের তাফসীর:

বানী ইসরাঈলের উপর পরম করুণাময় আল্লাহর যেসব নিয়ামত ছিল এখানে তিনি তারই বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি তাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন, তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছিলেন এবং তাদেরকে হুকুমত দান করেছিলেন। আর ঐ যুগের লোকদের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। দ্বীন সম্পর্কীয় উত্তম ও স্পষ্ট দলীল তিনি তাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের উপর আল্লাহর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর তারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষ বশতঃ বিরোধিতা করেছিল এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ ‘তোমার প্রতিপালক আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে ঐ বিষয়ের ফায়সালা করে দিবেন। এর দ্বারা উম্মতে মুহাম্মাদ (সঃ)-কে সতর্ক করা হয়েছে যে, তাদের চলনগতি যেন বানী ইসরাঈলের মত না হয়। এজন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তোমার প্রতিপালকের অহীর অনুসরণ কর, অজ্ঞ মুশরিকদের খেয়াল অনুসরণ করো না। তাদের সাথে তোমরা বন্ধুত্ব স্থাপন করো না। তারা তো পরস্পর বন্ধু। আর তোমাদের বন্ধু স্বয়ং আল্লাহ। অর্থাৎ মুত্তাকীদের বন্ধু হলেন আল্লাহ। তিনি তাদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকার হতে সরিয়ে জ্ঞানের আলোর দিকে নিয়ে আসেন। আর কাফিরদের বন্ধু হলো শয়তান। সে তাদেরকে জ্ঞানের আলো হতে সরিয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “এই কুরআন মানব জাতির জন্যে সুস্পষ্ট দলীল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্যে পথ-নির্দেশ ও রহমত।’
২১-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, মুমিন ও কাফির সমান নয়। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতবাসীরাই সফলকাম।”(৫৯:২০) এখানেও আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এরূপ হতে পারে না যে, কাফির ও দুষ্কৃতিকারী এবং মুমিন ও সৎকর্মশীল মরণ ও জীবনে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সমান হয়ে যাবে। যারা এটা মনে করে যে, আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে দুষ্কৃতিকারী ও মুমিনদেরকে সমান গণ্য করবো, তাদের সিদ্ধান্ত কতইনা মন্দ!

হযরত আবু যার (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা স্বীয় দ্বীনের ভিত্তি চারটি স্তম্ভের উপর স্থাপন করেছেন। যে ব্যক্তি এগুলো হতে সরে যাবে এবং এগুলোর উপর আমল করবে না সে পাপাসক্ত অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে।” জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে আবু যার (রাঃ)! ঐগুলো কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, হালাল ও হারাম এবং আদেশ ও নিষেধ এ চারটি বিষয় আল্লাহ তাআলারই অধিকারভুক্ত। তার হালালকে হালাল মেনে নেয়া, হারামকে হারাম বলেই স্বীকার করা, তার আদেশকে আমলযোগ্য ও স্বীকারযোগ্য রূপে মেনে নেয়া এবং তার নিষিদ্ধ কার্য হতে বিরত থাকা। হালাল, হারাম, আদেশ এবং নিষেধের মালিক একমাত্র আল্লাহকেই মনে করা। এগুলোই হলো দ্বীনের মূল। আবুল কাসেম (সঃ) বলেছেনঃ “বাবলা গাছ হতে যেমন আঙ্গুর ফল লাভ করা যায় না, ঠিক তেমনই অসৎপরায়ণ ব্যক্তি সৎকর্মশীল ব্যক্তির মর্যাদা লাভ করতে পারে না।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি গারীব বা দুর্বল)

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ)-এর সীরাত গ্রন্থে রয়েছে যে, কাবা শরীফের ভিত্তির মধ্যে একটি পাথর পাওয়া গিয়েছিল। তাতে লিখিত ছিলঃ “তোমরা দুষ্কর্ম করছো, আর কল্যাণ লাভের আশা রাখছে। এটা ঠিক ঐরূপ যেমন কেউ কোন কন্টকযুক্ত গাছ হতে আঙ্গুর ফলের আশা করে।”

বর্ণিত আছে যে, হযরত তামীম দারী (রাঃ) সারারাত ধরে তাহাজ্জুদের নামাযে বার বার … (আরবী)-এই আয়াতটি পড়তে থাকেন, শেষ পর্যন্ত ফজর হয়ে যায়। (এটা ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এজন্যেই আল্লাহ বলেনঃ “তাদের সিদ্ধান্ত কতই না মন্দ!’ এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন। কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবে না।

মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তার প্রতিও লক্ষ্য করেছে, যে তার খেয়াল-খুশীকে তার মা’বুদ বানিয়ে নিয়েছে। তার যে কাজ করতে মন চেয়েছে। তা সে করেছে। আর যে কাজ করতে তার মন চায়নি তা পরিত্যাগ করেছে।

এ আয়াতটি মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের এই মূল নীতিকে খণ্ডন করেছে যে, ভাল কাজ ও মন্দ কাজ হলো জ্ঞান সম্পকীয় ব্যাপার। ইমাম মালিক (রঃ) এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেনঃ যার ইবাদতের খেয়াল তার মনে জাগ্রত হয় তারই সে ইবাদত করতে শুরু করে। এর পরবর্তী বাক্যটির দু’টি অর্থ হবে। (প্রথম) আল্লাহ তাআলা স্বীয় জ্ঞানের ভিত্তিতে তাকে বিভ্রান্তির যোগ্য মনে করে তাকে বিভ্রান্ত করে দেন। (দ্বিতীয়) তার কাছে জ্ঞান, যুক্তি-প্রমাণ এবং দলীল-সনদ এসে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা তাকে বিভ্রান্ত করেন। এই দ্বিতীয় অর্থটি প্রথম অর্থটিকে অপরিহার্য করে এবং প্রথম অর্থ দ্বিতীয় অর্থকেও অপরিহার্য করে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তার কর্ণে মোহর রয়েছে, তাই সে শরীয়তের কথা শুনেই না এবং তার হৃদয়েও মোহর রয়েছে, তাই হিদায়াতের কথা তার হৃদয়ে স্থান পায় না। তার চক্ষুর উপর পর্দা পড়ে আছে, তাই সে কোন দলীল-প্রমাণ দেখতে পায় না। অতএব, আল্লাহর পরে কে তাকে পথ-নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথ-প্রদর্শক নেই এবং তিনি তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে দেন।”(৭:১৮৬)
২৪-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:

কাফিরদের দাহরিয়্যাহ সম্প্রদায় এবং তাদের সমবিশ্বাসী আরব-মুশরিকদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করে এবং বলেঃ কিয়ামত কোন জিনিসই নয়। দার্শনিক ও ইলমে কালামের উক্তিকারীরাও এ কথাই বলতো। তারা প্রথম ও শেষকে বিশ্বাস করতো না। দার্শনিকদের মধ্যে যারা দাহরিয়্যাহ ছিল তারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করতো। তাদের ধারণা ছিল যে, প্রতি ছত্রিশ হাজার বছর পর যুগের একটা পালা শেষ হয়ে যায় এবং প্রতিটি জিনিস নিজের আসল অবস্থায় চলে আসে। এই ধরনের তারা কয়েকটি দওর যা যুগের পালাতে বিশ্বাসী ছিল। প্রকৃতপক্ষে তারা যুক্তিসম্মত বিষয়েও ঝগড়া করতো এবং স্থানান্তরিত বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতো। তারা বলতো যে, কালচক্রই ধ্বংস আনয়নকারী, আল্লাহ তা’আলা নয়। আল্লাহ তা’আলা তাদের এ দাবী খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন যে, এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং কোন দলীল-প্রমাণও নেই। তারা শুধু মনগড়া কথা বলে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘আদম সন্তানরা আমাকে কষ্ট দেয়, তারা যুগকে গালি দেয়। অথচ যুগ তো আমি নিজেই। সমস্ত কাজ আমারই হাতে। দিবস ও রজনীর পরিবর্তন আমিই ঘটিয়ে থাকি।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা যুগকে গালি দিয়ো না, কেননা, আল্লাহ তা’আলাই তো যুগ।”

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, অজ্ঞতার যুগের লোকেরা বলতোঃ “রাত-দিনই আমাদেরকে ধ্বংস করে থাকে। এগুলোই আমাদেরকে মেরে ফেলে ও জীবিত রাখে। তাই আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে বলেনঃ “তারা বলে- একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি আর কালই আমাদেরকে ধ্বংস করে।” সুতরাং আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “বানী আদম আমাকে কষ্ট দেয়, তারা যামানাকে গালি দেয়, অথচ যামানা তো আমিই। সব কাজ আমারই হাতে। রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তন আমিই ঘটাই।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ইবনে আদম (আদম সন্তান) যুগ বা কালকে গালি দেয়, অথচ যুগ তো আমিই। আমারই হাতে রাত ও দিন।” (ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি আমার বান্দার কাছে কর্জ চেয়েছি কিন্তু সে আমাকে তা দেয়নি। আমার বান্দা আমাকে গালি দেয়। সে বলেঃ ‘হায় যুগ! অথচ যুগ তো আমিই।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) তাখরীজ করেছেন)

ইমাম শাফেয়ী (রঃ), ইমাম আবু উবাইদাহ (রঃ) প্রমুখ গুরুজন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ‘তোমরা যুগকে গালি দিয়ো না, কেননা আল্লাহই যুগ’ এই উক্তির তাফসীরে বলেন যে, অজ্ঞতার যুগের আরবরা যখন কোন কষ্ট ও বিপদ-আপদে পড়তো তখন যুগকে সম্পর্কযুক্ত করে গালি দিতো। প্রকৃতপক্ষে যুগ কিছুই করে না। সবকিছুই করেন একমাত্র আল্লাহ। কাজেই তাদের যুগকে গালি দেয়া অর্থ আল্লাহকেই গালি দেয়া যার হাতে ও যার অধিকারে রয়েছে যুগ। সুখ ও দুঃখের মালিক তিনিই। অতএব, গালি পড়ে প্রকৃত কর্তা অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার উপরই। এ কারণেই আল্লাহর নবী (সঃ) এ হাদীসে একথা বলেন এবং জনগণকে তা হতে নিষেধ করে দেন। এটাই সঠিক ব্যাখ্যা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) প্রমুখ গুরুজন এই হাদীস দ্বারা যে মনে করে নিয়েছেন যে, আল্লাহ তা’আলার উত্তম নামসমূহের মধ্যে দাহরও একটি নাম, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “তাদের নিকট যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন তাদের কোন যুক্তি থাকে না। অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত হওয়া এবং পুনর্জীবন দান করার স্পষ্ট ও উজ্জ্বল দলীল-প্রমাণ তাদের সামনে পেশ করা হলে তারা একেবারে নিরুত্তর হয়ে যায়। তাদের দাবীর অনুকূলে তারা কোন যুক্তি পেশ করতে পারে না। তখন তারা বলে ওঠেঃ “তোমরা তোমাদের কথায় সত্যবাদী হলে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে আমাদের সামনে উপস্থিত কর।’ অর্থাৎ তাদেরকে জীবিত করে দেখাতে পারলে আমরা ঈমান আনবো।’ আল্লাহ তা’আলা তাদের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তাদেরকে বলে দাও- তোমরা তোমাদের জীবন ধারণ ও মৃত্যুবরণ স্বচক্ষে দেখছো। তোমরা তো কিছুই ছিলে না। আল্লাহই তোমাদেরকে অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন। অতঃপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কিরূপে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনিই তোমাদেরকে জীবন্ত করেছেন, আবার তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনর্জীবন দান করবেন।”(২:২৮) অর্থাৎ যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনি মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দানে কেন সক্ষম হবেন না? এটা তো জ্ঞানের দ্বারাই উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে, যিনি বিনা নমুনাতেই কোন জিনিস তৈরী করতে পারেন, ওটাকে দ্বিতীয়বার তৈরী করা তো তাঁর পক্ষে প্রথমবারের চেয়ে বেশী সহজ।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তিনি তোমাদেরকে কিয়ামত দিবসে একত্রিত করবেন যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি তোমাদেরকে পুনরায় দুনিয়ায় আনয়ন করবেন না, যেমন তোমরা বলছো যে, তোমাদের বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষদেরকে পুনর্জীবন দান করে আবার দুনিয়ায় উপস্থিত করা হোক। দুনিয়া তো আমলের জায়গা। প্রতিফল ও প্রতিদানের জায়গা হবে কিয়ামতের দিন। এই পার্থিব জীবনে কিছুটা অবকাশ দেয়া হয়, যাতে কেউ ইচ্ছা করলে ঐ পারলৌকিক জীবনের জন্যে কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং তোমাদের এ বিষয়ে জ্ঞান নেই বলেই তোমরা কিয়ামতকে অস্বীকার করছে। কিন্তু এটা মোটেই উচিত নয়। তোমরা এটাকে খুবই দূরে মনে করছে, কিন্তু আসলে এটা খুবই নিকটে। তোমরা এটা সংঘটিত হওয়াকে অসম্ভব মনে করলেও এটা সংঘটিত হবেই। এতে কোনই সন্দেহ নেই। বাস্তবিকই মুমিনরা জ্ঞানী ও বিবেকবান, তাই তো তারা এর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আমল করছে।
২৭-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, আজ হতে নিয়ে চিরদিনের এবং আজকের পূর্বেও সারা আকাশের, সারা যমীনের মালিক, বাদশাহ, সুলতান, সম্রাট একমাত্র আল্লাহ। যারা আল্লাহকে, তাঁর রাসূলদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে এবং কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করে তারা কিয়ামতের দিন ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) মদীনায় এসে শুনতে পান যে, মুআফেরী একজন রসিক লোক। নিজের কথায় তিনি লোকদেরকে হাসাতেন। তিনি তাঁকে বললেন, জনাব! আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত?” হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ)-এর একথা হযরত মুআফেরী (রঃ)-এর উপর খুবই ক্রিয়াশীল হয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ উপদেশ ভুলেননি। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ঐ দিন এতো ভয়াবহ ও কঠিন হবে যে, প্রত্যেকে হাঁটুর ভরে পড়ে থাকবে। এ অবস্থা ঐ সময় হবে যখন জাহান্নাম সামনে আনা হবে এবং ওটা এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস নিবে। এমনকি ঐ সময় হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ) এবং হযরত ঈসা রূহুল্লাহরও (আঃ) মুখ দিয়ে নাফসী নাফসী শব্দ বের হবে। তারাও সেদিন প্রত্যেকে পরিষ্কারভাবে বলবেনঃ “হে আল্লাহ! আজকে আমি আমার জীবনের নিরাপত্তা ছাড়া আপনার কাছে আর কিছুই চাই না।” হযরত ঈসা (আঃ) বলবেনঃ “হে আল্লাহ! আজ আমি আমার মাতা মরিয়ম (আঃ)-এর জন্যেও আপনার কাছে কিছুই আরয করছি না। সুতরাং আমাকে রক্ষা করুন!” কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে- প্রত্যেক দল পৃথক পৃথকভাবে থাকবে। কিন্তু উত্তম তাফসীর ওটাই যা আমরা বর্ণনা করলাম অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজ নিজ হাঁটুর ভরে পড়ে থাকবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বাবাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি যেন তোমাদেরকে জাহান্নামের পার্শ্বে হাঁটুর ভরে ঝুঁকে পড়া অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি।” (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অন্য একটি মারফু হাদীস রয়েছে, যাতে সূর (শিঙ্গা) ইত্যাদির বর্ণনা আছে, তাতে এও রয়েছে যে, এরপর লোকদেরকে পৃথক পৃথক করে দেয়া হবে এবং সমস্ত উম্মত জানুর উপর ঝুঁকে পড়বে। আল্লাহ তা’আলা এখানে ঐ কথাই বলেনঃ ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তুমি দেখবে নতজানু (শেষ পর্যন্ত)। এখানে দু’টি অবস্থাকে একত্রিত করা হয়েছে। সুতরাং দু’টি তাফসীর একটি অপরটির বিপরীত নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ প্রত্যেক সম্প্রদায়র্কে তার আমলনামার প্রতি আহ্বান করা হবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমলনামা রাখা হবে এবং নবীদেরকে ও শহীদদেরকে আনয়ন করা হবে।”(৩৯:৬৯) এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে যা তোমরা করতে।’ অর্থাৎ আজ তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিটি কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে কি অগ্রে পাঠিয়েছে এবং কি পশ্চাতে রেখে গিয়েছে। বস্তুতঃ মানুষ নিজের সম্বন্ধে সম্যক অবগত, যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে।”(৭৫:১৩-১৫)।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ‘এই আমার লিপি, এটা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে সত্যভাবে। অর্থাৎ ঐ আমলনামা যা আমার বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে, যাতে বিন্দুমাত্র কমবেশী করা হয়নি, তা তোমাদের বিরুদ্ধে আজ সত্যভবে সাক্ষ্য প্রদান করবে। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আর উপস্থিত করা হবে আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে। তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতংকগ্রস্ত এবং তারা বলবেঃ হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! এটা তো ছোট বড় কিছুই বাদ দেয়নি; বরং এটা সমস্ত হিসাব রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে; তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি যুলুম করেন না।”(১৮:৪৯)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা যা করতে তা আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম।’ অর্থাৎ আমি আমার রক্ষক ফেরেশতাদেরকে তোমাদের আমলনামা লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। সুতরাং তারা তোমাদের সমস্ত আমল লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ মনীষী বলেন যে, ফেরেশতারা বান্দাদের আমল লিপিবদ্ধ করার পর ঐগুলো নিয়ে আকাশে উঠে যান। আসমানের দেওয়ানে আমলের ফেরেশতাগণ ঐ আমলনামাকে লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আমলের সাথে মিলিয়ে দেখেন যা প্রতি রাত্রে ওর পরিমাণ অনুযায়ী তাদের উপর প্রকাশিত হয়, যা আল্লাহ তাআলা স্বীয় মাখলুকের সৃষ্টির পূর্বেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তখন ফেরেশতারা একটি অক্ষরও কম বেশী পান না। অতঃপর তিনি (আরবী)-এই অংশটুকু তিলাওয়াত করেন।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৬-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

বানী ইসরাঈলকে যে সকল নেয়ামত দান করা হয়েছিল উক্ত আয়াতগুলোতে তার কয়েকটি উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি বানী ইসরাঈলকে কিতাব অর্থাৎ তাওরাত দান করেছিলাম এবং দিয়েছিলাম রাজত্ব বা শাসন ক্ষমতা অথবা বিবেক ও বিচার করার এমন যোগ্যতা, যা মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য জরুরী ছিল। তাদেরকে দান করা হয়েছিল নবুওয়াত, আকাশ হতে মান্না-সালওয়াসহ আরো উত্তম রিযিক এবং তাদেরকে বিশ্ববাসীর ওপর তথা তৎকালীন বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছিল। এছাড়াও তাদেরকে দেয়া হয়েছিল হালাল-হারাম বিবৃত স্পষ্ট বিধান। তাদের নিকট সঠিক জ্ঞান আসার পর তারা পদ-মর্যাদার জন্য পরস্পর হিংসা ও বিদ্বেষবশত দীনের ব্যাপারে মতবিরোধ করতে শুরু করে এবং রাসূলের রিসালাতকে অস্বীকার করে, ফলে তারা শাস্তির হকদার হয়ে যায়।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা উম্মাতে মুহাম্মাদীকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, তারা যেন বানী ইসরাঈলের মতো না হয়। তারা যেন কোন ব্যক্তির বা অজ্ঞ-মুশরিকদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ না করে।

(بَغْيًاۭ بَيْنَهُمْ) অর্থ আপোসে একে অপরের প্রতি হিংসা বা বিদ্বেষ পোষণ করা।

شريعة আভিধানিক অর্থ হলো- রাস্তা, ধর্মাদেশ, বিধান ও নিয়ম-পদ্ধতি। রাজপথ বা প্রধান সড়ককে شارع বলা হয়। কারণ তা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। তাই শরীয়ত বলতে সে দীনের বিধানকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে সে পথে চলে মানুষ আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে।

(فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَا۬ءَ)

অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর উম্মাতকে এ শরীয়তের অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কারণ শরীয়তের বাইরে কিছুই নেই, কোন ব্যক্তির আল্লাহ তা‘আলার কাছে পৌঁছতে ও আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য শরীয়তের যথাযথ অনুসরণই যথেষ্ট। সুতরাং যাদের শরীয়ত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই, যাদের বিশ্বাস কেবল শরীয়তের অনুসরণ করেই একজন ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার ও আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাসিল করতে পারবে না, বরং তরীকত, মারেফত ধারাক্রম অতিক্রম করে হাকিকত পর্যায়ে পৌঁছতে হবে তারা সঠিক বিষয়ের অনুসারী নয়, বরং তারা ভ্রান্ত ও রাসূলুল্লাহ এর আনীত শরীয়ত বর্হিভূত বিষয়ের অনুসারী।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বানী ইসরাঈলের যে মর্যাদা ছিল তা জানা গেল।
২. এমন ব্যক্তি যে শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে অজ্ঞ তার অনুসরণ করা যাবে না।
৩. মু’মিনদের বন্ধু স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা।
৪. আল-কুরআন মানব জাতির জন্য পথ-নির্দেশ।
২১-২৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে, মৃত্যুর পর তাদের আর কোনই শাস্তি হবে না। তারা বলে, মৃত্যুর পর আমরা সবাই মাটিতে মিশে যাব, এর বেশি আর কিছুই হবে না। অথবা, যেভাবে দুনিয়াতে ওরা সমান সমান ছিল, অনুরূপ পরকালেও সমান সমান থাকবে। মরে সবাই শেষ হয়ে যাব। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে- না, এরূপ কখনোই হবে না। বরং মৃত্যুর পর পাপীদেরকে শাস্তি দেয়া হবে আর মু’মিনদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। উভয়কে সমান সমান করা হবে না। কারণ মু’মিনগণ তাদের তুলনায় অধিক উত্তম। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(لَا يَسْتَوِيْٓ أَصْحٰبُ النَّارِ وَأَصْحٰبُ الْجَنَّةِ ط أَصْحٰبُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَا۬ئِزُوْنَ)

“জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতবাসীরাই সফলকাম।” (সূরা হাশর ৫৯ : ২০)
আর এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কতই না মন্দ সিদ্ধান্ত। কারণ তিনি আকাশ ও জমিন সৃষ্টিই করেছেন এ জন্য যে, তিনি তাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফায়সালা করবেন। যে ব্যক্তি যেমন আমল করবে তাকে তদ্রƒপ প্রতিদান দেয়া হবে, কোন প্রকার জুলুম বা অত্যাচার করা হবে না।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা একটি উপমা বর্ণনা করেছেন ঐ ব্যক্তির, যে নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। যার ফলে সে হক ও বাতিলের পার্থক্য করতে পারে না, বরং তার প্রবৃত্তি যেটাকে ভাল মনে করে সেটাকেই সে ভাল মনে করে, আর প্রবৃত্তি যেটাকে খারাপ মনে করে সেটাকেই খারাপ মনে করে। আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের বিধি-বিধানের ওপর সে তার প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাকে বিভ্রান্ত করেছেন। কারণ তিনি জানেন যে, সে এ ভ্রষ্টতারই উপযুক্ত। যার ফলে ভাল কথা শ্রবণ করা থেকে তার কান এবং হিদায়াত গ্রহণ করা হতে তার অন্তর বঞ্চিত হয়ে গেছে। আর তার চোখের ওপর পড়ে গেছে আবরণ যার কারণে সে সত্য জিনিস দেখতে পায় না। কারণ আল্লাহ জানেন সে এ পথেরই উপযুক্ত। আর আল্লাহ তা‘আলা যাকে বিভ্রান্ত করেন সে কখনো সঠিক পথ পায় না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(مَنْ يُّضْلِلِ اللّٰهُ فَلَا هَادِيَ لَه۫ ط وَيَذَرُهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)‏

“আল্লাহ যাদেরকে পথভ্রষ্ট করেন তাদের কোন পথপ্রদর্শক নেই, আর তাদেরকে তিনি তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৮৬)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সৎ কর্মপরায়ণ ও অসৎ কর্মপরায়ণ ব্যক্তির প্রতিদান কখনো সমান হতে পারে না।
২. প্রত্যেককে তার যথাযথ প্রাপ্য দেয়া হবে, কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম করা হবে না।
৩. নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করা যাবে না। কেননা প্রবৃত্তি কখনো ভাল কাজ করতে সম্মতি দেয় না।
২৪-২৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

মক্কার কাফির-মুশরিকরা বলত, একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন। বেঁচে আছি, মারা যাব, মহাকালের বিবর্তণে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। এটাই হলো বর্তমান যুগের নাস্তিকদের উক্তি, যারা পুনর্জীবন ও পরকালকে অস্বীকার করে। তারা বলে যে, পার্থিব এ জীবনই হলো প্রথম ও শেষ জীবন। এরপর আর কোন জীবন নেই এবং এতে জীবন ও মরণের যে ধারাবাহিকতা চলে আসছে, তা কেবল প্রাকৃতিক নিয়ম। যেমন দার্শনিকদের একটি দল বলে যে, প্রত্যেক ছত্রিশ হাজার বছর পর প্রতিটি জিনিস পুনরায় তার অবস্থায় ফিরে আসে। আর এ ধারাবাহিকতা কোন স্রষ্টা ও পরিচালক ছাড়াই অব্যাহত আছে ও থাকবে। না তার কোন শুরু আছে, আর না শেষ। এ দলকে “দাহরিয়া” বলা হয়। তাদের এ কথার পক্ষে কোনই দলীল-প্রমাণ নেই।

মক্কার কাফির-মুশরিকরাও এরূপ মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। এ মতবাদ জ্ঞান ও যুক্তির পরিপন্থী এবং তা কুরআন ও সহীহ হাদীসেরও পরিপন্থী। যুগের বিবর্তণে মানুষ ধ্বংস হয় না বা মারা যায় না, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জীবকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, সেই নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলে তাকে মৃত্যু দান করেন। আবার তাকে কৃতকর্মের ফলাফল দেয়ার জন্য পুনরায় জীবিত করবেন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়; তারা কালকে গালি দেয়, অথচ আমিই হলাম কাল বা যুগ। আমার হাতেই এর এখতিয়ার। আমিই রাত ও দিনের আগমন ও প্রত্যাগমন ঘটাই। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮২৬, সহীহ মুসলিম হা. ২২৪৬)

এ সকল ধ্যান-ধারণার উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, শুধুমাত্র কাল্পনিক ধারণা ব্যতীত এ ব্যাপারে তাদের কোনই জ্ঞান নেই।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা যত যা কিছুই মনে করুক না কেন আমিই তাদেরকে মৃত্যু দান করি এবং মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করি, আমিই তাদেরকে কিয়ামতের মাঠে একত্রিত করব। শুধু তাই নয় তাদেরকে প্রথমবার যে জীবন দান করা হয়েছিল তাও আমিই দিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَهُوَ الَّذِيْ يَبْدَؤُا الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُه۫ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ ط وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلٰي فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ج وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‏)‏

“তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনিই আবার তা পুনরাবৃত্তি করবেন; এটা তার জন্য খুবই সহজ। আসমান ও জমিনে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই। আর তিনিই প্রতাপশালী মহাবিজ্ঞ।” (সূরা রূম ৩০ : ২৭)

সুতরাং যে যাই মনে করুক না কেন, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেককে তার মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করবেন এবং তার কৃতকর্মের হিসাব নেবেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কোন কিছুই প্রাকৃতিক নিয়মে হয় না বরং প্রত্যেক জিনিসেরই একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে।
২. যুগকে গালি দেয়া যাবে না, কারণ স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই যুগের পরিবর্তন করেন।
৩. কিয়ামত সংঘটিত হবে, আর সেদিন প্রত্যেককেই পুনরায় জীবিত করা হবে।
২৭-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের মাঠের করুণ অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন মিথ্যাবাদীরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত, ঐ দিনের অবস্থা এতই ভয়াবহ হবে যে, প্রত্যেক সম্প্রদায় ভয়ে নতজানু হয়ে পড়ে থাকবে। কেউ কথা বলার সাহস পাবে না। প্রত্যেকেই শুধু ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসী- তথা হায় আমার কী হবে, আমার কী হবে? -বলতে থাকবে। এমন সময় তাদেরকে হিসাবের জন্য ডাকা হবে ও তাদের আমলনামা সামনে পেশ করা হবে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُوْرِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتٰبُ وَجِيْ۬ءَ بِالنَّبِيِّيْنَ وَالشُّهَدَا۬ءِ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْحَقِّ وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ)

“সমস্ত পৃথিবী তার প্রতিপালকের নূরে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা পেশ করা হবে এবং নাবীগণকে ও সাক্ষীগণকে হাজির করা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায়বিচার করা হবে ও তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” (সূরা যুমার ৩৯ : ৬৯)

প্রত্যেককে তার কৃত আমলের প্রতিদান দেয়া হবে। কারো প্রতি অত্যাচার করা হবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(یُنَبَّؤُا الْاِنْسَانُ یَوْمَئِذٍۭ بِمَا قَدَّمَ وَاَخَّرَﭜبَلِ الْاِنْسَانُ عَلٰی نَفْسِھ۪ بَصِیْرَةٌﭝ وَّلَوْ اَلْقٰی مَعَاذِیْرَھ۫)

“সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে যা সে অগ্রে পাঠিয়েছে ও পশ্চাতে রেখে গেছে। বরং মানুষ নিজের সম্বন্ধে ভাল করে জানে, যদিও সে নানা অজুহাত পেশ করে।” (সূরা কিয়ামাহ্ ৭৫ : ১৩-১৫)

তাদের এ সকল আমলনামা ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছিল, যারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর আমল লিপিবদ্ধ করতেও বাদ দেননি।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَوُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَي الْمُجْرِمِيْنَ مُشْفِقِيْنَ مِمَّا فِيْهِ وَيَقُوْلُوْنَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَّلَا كَبِيْرَةً إِلَّآ أَحْصَاهَا ج وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا ط وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا)

“এবং উপস্থিত করা হবে আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধিদের আতঙ্কগ্রস্ত‎ দেখবে এবং তারা বলবে, ‘হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! যাতে ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়া হয়নি; বরং সমস্ত‎ই হিসেব রেখেছে।’ তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে; তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি জুলুম করেন না। ” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৪৯)

সুতরাং মানুষের সেখানে শাস্তি থেকে মুক্তি পাবার কোনই পথ খোলা থাকবে না একমাত্র সৎ আমল ব্যতীত। যে ব্যক্তি সৎ আমল করবে সে কিয়ামতের মাঠের এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে। অন্যথায় তাকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের মাঠে প্রত্যেকে ভয়ে নতজানু অবস্থায় পড়ে থাকবে। এখানে মানুষের আমলনামা পেশ করা হবে। আর তথায় আমলনামা তাদের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলবে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# হুকুম অর্থ তিনটি জিনিস। এক-কিতাবের জ্ঞান ও উপলব্ধি এবং দ্বীনের অনুভূতি। দুই-কিতাবের অভিপ্রায় অনুসারে কাজ করার কৌশল। তিন-বিভিন্ন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা।
# এ নয় যে, চিরদিনের জন্য সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর মর্যাদা দান করেছেন। বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, সেই যুগে দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্য থেকে আল্লাহ‌ বনী ইসরাইলকে এই খেদমতের জন্য বাছাই করে নিয়েছিলেন যে, তারা হবে আল্লাহর কিতাবের ধারক এবং আল্লাহর আনুগত্যের ঝাণ্ডাবাহী।
# ইতিপূর্বে যে কাজের দায়িত্ব বনী ইসরাইলদের ওপর অর্পণ করা হয়েছিলো এখন তার দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। তারা জ্ঞান লাভ করা সত্ত্বেও আত্মস্বার্থের জন্য দ্বীনের মধ্যে এমন মতভেদ সৃষ্টি করে এবং পরস্পর এমন দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে যার ফলে দুনিয়ার মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান জানানোর যোগ্যতাই হারিয়ে বসে। বর্তমানে তোমাদের সেই দ্বীনের সুস্পষ্ট রাজপথের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে তোমরা সেই খেদমত আঞ্জাম দিতে পার যা বনী ইসরাঈলরা পরিত্যাগ করেছে এবং যার যোগ্যতাও তাদের ছিল না। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, সূরা আশ শূরা, আয়াত ১৩ থেকে ১৫ এবং টীকা ২০ থেকে ২৬ )।
# যদি তোমরা তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য দ্বীনের মধ্যে কোনো প্রকার রদবদল করো তাহলে তারা আল্লাহর সামনে জবাবদিহি থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না।
# এই কিতাব এবং এই শরীয়ত পৃথিবীর মানুষের জন্য এমন এক আলো যা হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কিন্তু তা থেকে হিদায়াত লাভ করে কেবল সেই সব লোক যারা তার সত্যতার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। আর তা রহমত কেবল তাদের জন্যই।
# তাওহীদের দিকে আহবান জানানোর পর এখান থেকে আখেরাত সম্পর্কে বক্তব্য শুরু হচ্ছে।
# আখেরাত সত্য হওয়ার সপক্ষে এটা নৈতিক যুক্তি-প্রমাণ। নৈতিক চরিত্রের ভাল-মন্দ এবং কর্মের মধ্যে সৎ ও অসতের পার্থক্যের অনিবার্য দাবী হলো ভাল মন্দ লোকের পরিণাম এক হবে না বরং এক্ষেত্রে সৎ লোক তার সৎ কাজের ভাল প্রতিদান লাভ করবে এবং অসৎ লোক তার অসৎ কাজের মন্দ ফল লাভ করবে। তা যদি না হয় এবং ভাল ও মন্দের ফলাফল যদি একই রকম হয় সে ক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্রের ভাল ও মন্দের পার্থক্যই অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে বে-ইনসাফর অভিযোগ আরোপিত হয়। যারা পৃথিবীতে অন্যায়ের পথে চলে তারা তো অবশ্যই চাইবে যেন কোনো প্রকার প্রতিদান ও শাস্তির ব্যবস্থা না থাকে। কারণ, এই ধারণাই তাদের আরামকে হারাম করে দেয়। কিন্তু বিশ্বজাহানের রব আল্লাহর যুক্তিপূর্ণ বিধান ও ন্যায় বিচারের নীতির সাথে এটা আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় যে, তিনি সৎ ও অসৎ উভয় শ্রেণীর মানুষের সাথে একই রকম আচরণ করবেন এবং সৎকর্মশীল ঈমানদার ব্যক্তিগণ পৃথিবীতে কিভাবে জীবন যাপন করেছে আর কাফের ও ফাসেক ব্যক্তিরা কী বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তার কিছুই দেখবেন না। এক ব্যক্তি সারা জীবন নিজেকে নৈতিকতার বিধি-বন্ধনে আবদ্ধ রাখলো, প্রাপকদের প্রাপ্য অধিকার দিল, অবৈধ স্বার্থ ও ভোগের উপকরণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখলো এবং ন্যায় ও সত্যের জন্য নানা রকম ক্ষতি বরদাশত করলো। আরেক ব্যক্তি সম্ভাব্য সব উপায়ে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা পূরণ করলো। সে না আল্লাহর অধিকার চিনলো, না বান্দার অধিকার হস্তক্ষেপ থেকে বিরত হল এবং স্বার্থ ও ভোগের উপকরণ যেভাবে সম্ভব দুই হাতে আহরণ করলো। আল্লাহ এই দুই শ্রেণীর মানুষের জীবনের এই পার্থক্য উপেক্ষা করবেন তা কি আশা করা যায়? মৃত্যু পর্যন্ত যাদের জীবন এক রকম হলো না, মৃত্যুর পরে তাদের পরিণাম যদি একই রকম হয় তাহলে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় বে-ইনসাফী আর কী হতে পারে? (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, ইউনুস, টীকা ৯ ও ১০ ; হূদ, টীকা ১০৬ ; আন নাহল, টীকা ৩৫ ; আল হাজ্ব, টীকা ৯ ; আন নামল, টীকা ৮৬ ; আর রূম, টীকা ৬ থেকে ৮ ; সূরা সোয়াদ, আয়াত ২৮, টীকা ৩০ )।
# আল্লাহ‌ খেল-তামাশা করার উদ্দেশ্যে পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টি করেননি। বরং এটা একটা উদ্দেশ্যমুখী জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় একথা একেবারই অকল্পনীয় যে, যারা আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও উপায়-উপকরণ সঠিক পন্থায় ব্যবহার করে ভাল কাজ করেছে এবং যারা ঐগুলোকে ভ্রান্ত পন্থায় ব্যবহার করে জুলুম ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে শেষ পর্যন্ত তারা সবাই মরে মাটিতে পরিণত হবে এবং এই মৃত্যুর পর আর কোন জীবন হবে না এবং সেখানে ইনসাফ মোতাবেক তাদের ভাল ও মন্দ কাজের কোন ভাল বা মন্দ ফলাফলও প্রকাশ পাবে না। যদি তাই হয় তাহলে এই বিশ্ব জাহান তো খেলোয়াড়ের খেলার বস্তু, কোন মহাজ্ঞানীর সৃষ্ট উদ্দেশ্যমুখী ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা নয়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনয়াম, টীকা ৪৬ ; ইউনুস, টীকা ১১ ; ইবরাহীম টীকা ২৬ ; আন নাহল, টীকা ৬ ; আল আনকাবূত, টীকা ৭৫ এবং আর রূম, টীকা ৬ )।
# পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষাপটে এ আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হলো, সৎ মানুষেরা যদি তাদের সৎ কাজের পুরস্কার বা প্রতিদান না পায়, জালেমদেরকে তাদের শাস্তি না দেয়া হয় এবং মজলুমরা কখনো ন্যায় বিচার না পায় তাহলে তা হবে জুলুম। আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ব্যবস্থায় এ ধরনের জুলুম কখনো হতে পারে না। একইভাবে কোন মানুষকে তার প্রাপ্যের তুলনায় কম পুরস্কার দেয়া হবে কিংবা কোন অসৎ মানুষকে তার প্রাপ্যের তুলনায় অধিক শাস্তি দেয়া হবে আল্লাহর বিচারে এ ধরনের কোন জুলুমও হতে পারে না।
# প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে খোদা বানিয়ে নেয়ার অর্থ ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার দাস হয়ে যাওয়া। তার মন যা চায় তাই সে করে বসে যদিও আল্লাহ তা হারাম করেছেন এবং তার মন যা চায় না তা সে করে না যদিও আল্লাহ তা ফরয করে দিয়েছেন। ব্যক্তি যখন এভাবে কারো আনুগত্য করতে থাকে তখন তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তার উপাস্য আল্লাহ নয়, বরং সে এভাবে যার আনুগত্য করছে সে-ই তার উপাস্য। সে মুখে তাকে ‘ইলাহা’ এবং উপাস্য বলুক বা না বলুক কিংবা মূর্তি তৈরী করে তার পূজা করুক বা না করুক তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ, দ্বিধাহীন আনুগত্যই তার উপাস্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবে কার্যত শিরক করার পর কোন ব্যক্তি শুধু এই কারণে শিরকের অপরাধ থেকে মুক্ত হতে পারে না যে, সে যার আনুগত্য করছে মুখে তাকে উপাস্য বলেনি এবং সিজদাও করেনি। অন্যান্য বড় বড় মুফাসসিরও আয়াতটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে জারীর এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এইভাবে যে, সে তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে। প্রবৃত্তি যা কামনা করেছে সে তাই করে বসেছে। না সে আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হারাম বলে মনে করেছে, না তার হালালকৃত বস্তুকে হালাল বলে গণ্য করেছে। আবু বকর জাসসাস এর অর্থ বর্ণনা করেছেন, “কেউ যেমনভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে সে ঠিক তেমনিভাবে প্রবৃত্তি আকাঙ্ক্ষার আনুগত্য করে।” যামাখশারী এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “সে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার প্রতি অত্যন্ত অনুগত। তার প্রবৃত্তি তাকে যেদিকে আহবান জানায় সে সেদিকেই চলে যায়। সে এমনভাবে তার দাসত্ব করে যেমন কেউ আল্লাহর দাসত্ব করে” (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল ফুরকান, টীকা ৫৬; সূরা সাবার ব্যাখ্যা, টীকা ৬৩; ইয়াসীন, টীকা ৫৩; আশ শূরা, টীকা ৩৮)।
# মূল বাক্যাংশ হচ্ছে أَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ । এই বাক্যাংশের একটি অর্থ হতে পারে এই যে, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পক্ষ থেকে সে ব্যক্তিকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কেননা সে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাস হয়ে গিয়েছিলো। আরেকটি অর্থ হতে পারে এই যে, সে তার প্রবৃত্তির ইচ্ছা ও কামনা-বাসনাকে খোদা বানিয়ে বসেছে এ বিষয়টি জেনে আল্লাহ তাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।
# আল্লাহ কর্তৃক কাউকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ, তার মন ও কানের ওপর মোহর লাগিয়ে দেয়া এবং চোখের ওপর আবরণ সৃষ্টি করে দেয়ার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে এ গ্রন্থের কয়েকটি স্থানে করেছি। দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারা, টীকা ১০ ও ১৬ ; আল আনয়াম, টীকা ১৭ ও ২৭ ; আল আরাফ, টীকা ৮০ ; আত তাওবা, টীকা ৮৯ ও ৯৩ ; ইউনুস, টীকা ৭১ ; আর রা’দ, টীকা ৪৪ ; ইবরাহীম, টীকা ৬ , ৭ ও ৪০ ; আন নাহল, টীকা ১১০ ; বনী ইসরাঈল, টীকা ৫১ ; আর রূম, টীকা ৮৪ ; ফাতের, আয়াত ৮, টীকা ১৬ ও ১৭ এবং আল মু’মিন, টীকা ৫৪ ।
# যে প্রসঙ্গে এ আয়াতটি এসেছে তাতে আপনা থেকেই একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যারা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাসত্ব করতে চায় প্রকৃতপক্ষে সেই সব লোকই আখেরাতকে অস্বীকার করে এবং আখেরাতে বিশ্বাসকে নিজের স্বাধীনতার পথের অন্তরায় মনে করে। তা সত্ত্বেও তারা যখন আখেরাতকে অস্বীকার করে বসে তখন তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এবং প্রতিনিয়তই তারা আরো বেশী করে গোমরাহীর মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে। এমন কোন অপকর্ম থাকে না যাতে জড়িত হওয়া থেকে তারা বিরত থাকে। কারো হক মারতে তারা দ্বিধান্বিত হয় না। ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি তাদের মনে কোন শ্রদ্ধা থাকে না। তাই কোনো প্রকার জুলুম ও বাড়াবাড়ির সুযোগ লাভের পর তা থেকে তারা বিরত থাকবে এ আশা করা যায় না। যেসব ঘটনা দেখে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সেই সব ঘটনা তাদের চোখের সামনে আসে কিন্তু তারা তা থেকে যে শিক্ষা গ্রহণ করে তা হচ্ছে, আমরা যা কিছু করছি ঠিকই করছি এবং এসবই আমাদের করা উচিত। কোন উপদেশ বাণীই তাদের প্রভাবিত করে না। কোন মানুষকে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য যে যুক্তি প্রমাণ ফলপ্রসূ হতে পারে তা তাদের আবেদন সৃষ্টি করে না। বরং তারা তাদের এই লাগামহীন স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি প্রমাণ খুঁজে খুঁজে বের করে। ভাল চিন্তার পরিবর্তে তাদের মন ও মস্তিষ্ক রাত-দিন সম্ভাব্য সকল পন্থায় তাদের নিজেদের স্বার্থ ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার চেষ্টায় লেগে থাকে। আখেরাত বিশ্বাসের অস্বীকৃতি যে মানুষের নৈতিক চরিত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক এটা তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। মানুষকে যদি মনুষ্যত্বের গণ্ডির মধ্যে কোন জিনিস ধরে রাখতে সক্ষম হয় তাহলে তা পারে কেবল এই অনুভূতি যে, আমরা দায়িত্ব মুক্ত নই, বরং আল্লাহর সামনে আমাদের সকল কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এই অনুভূতিহীন হওয়ার পর কেউ যদি অতি বড় জ্ঞানীও হয় তাহলেও সে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ না করে পারে না।
# জ্ঞানের এমন কোন মাধ্যমই নেই যার সাহায্যে তারা জেনে নিতে পারে, এই জীবনের পরে মানুষের আর কোন জীবন নেই। তাছাড়া এ কথা জানতেও কোন মাধ্যম নেই যে, কোন খোদার নির্দেশে জান কবজ করা হয় না, বরং শুধু কালের প্রবাহ ও বিবর্তনে মানুষ মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আখেরাত অবিশ্বাসীরা জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়, শুধু ধারণার ভিত্তিতে এসব কথা বলে থাকে। যদি তারা জ্ঞানের ভিত্তিতে কথা বলে তাহলে বড় জোর বলতে পারে যে, “মৃত্যুর পরে কোন জীবন আছে কিনা তা আমরা জানি না।” কিন্তু একথা বলতে পারে না যে, আমরা জানি, এই জীবনের পরে আর কোন জীবন নেই। অনুরূপ জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে তারা একথা জানার দাবী করতে পারে না যে, মানুষের রুহ আল্লাহর হুকুমে বের করে নেয়া হয় না, বরং একটি ঘড়ি যেমন চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যায় তেমনি তা মরে নিঃশেষ হয়ে যায়। তারা বড় জোর যা কিছু বলতে পারে তা শুধু এই যে, এ দু’টির মধ্যে কোনটি সম্পর্কেই আমরা জানি না, প্রকৃতই কি ঘটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের জ্ঞানের সীমা পর্যন্ত মৃত্যুর পরের জীবন হওয়া না হওয়া এবং রুহ কবজ হওয়া অথবা কালের প্রবাহে আপনা থেকেই মরে যাওয়ার সমান সম্ভাবনা যখন বিদ্যমান তখন এসব লোক আখেরাতের সম্ভাবনার দিকটি বাদ দিয়ে আখেরাত অস্বীকৃতির পক্ষে যে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত প্রদান করছে তার কারণ তাহলে কী? প্রকৃতপক্ষে তারা এই বিষয়টি চূড়ান্ত সমাধান যুক্তি-প্রমাণ ভিত্তিতে করে না বরং নিজেরদের কামনা-বাসনার নিরিখে করে থাকে। এছাড়া কি এর আর কোন কারণ থাকতে পারে? যেহেতু তারা মৃত্যুর পরে আর কোন জীবন চায় না এবং মৃত্যু সত্যিকার অর্থে অস্তিত্বহীনতা বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া না হয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে রুহ কবজ করা হোক এটাও তারা চায় না, তাই নিজেদের মনের চাহিদা অনুসারে তারা আকীদা-বিশ্বাস গড়ে নেয় এবং এর বিপরীত জিনিসটি অস্বীকার করে বসে।
# যেসব আয়াতে আখেরাতের সম্ভাবনার মজবুত যুক্তিসঙ্গত দলীল প্রমাণ পেশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আখেরাত হওয়া সরাসরি যুক্তি ও ইনাসাফের দাবি। আখেরাত সংঘটিত না হলে এই গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
# অন্য কথায়, তাদের এই যুক্তির উদ্দেশ্য ছিল, যখনই কেউ তাদেরকে বলবে, মৃত্যুর পর আরো একটি জীবন হবে। যদি তা না করা হয় তাহলে তারা একথা মানতে প্রস্তুত নয় যে, মৃত মানুষকে আবার কোন সময় পুনরায় জীবিত করে উঠানো হবে।। অথচ কেউ কখনো তাদেরকে একথা বলেনি যে, মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে এই পৃথিবীতে মৃতদের জীবিত করা হবে। যা কিছু বলা হয়েছে তা হচ্ছে, কিয়ামতের পরে আল্লাহ এক সময় যুগপৎ সমস্ত মানুষকে পুনরায় জীবিত করবেন এবং তাদের সবার কৃতকর্ম পর্যালোচনা করে পুরস্কার ও শাস্তি দানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
# তারা বলতো, কালের প্রবাহ ও সময়ের বিবর্তনের আপনা থেকেই মৃত্যু আসে। এটা তাদের সেই কথার জবাব। বলা হচ্ছে, না তোমরা আকস্মিকভাবে জীবন লাভ করে থাকো, না আপনা থেকেই তোমাদের মৃত্যু সংঘটিত হয়। একজন আল্লাহ‌ আছেন, যিনি তোমাদের জীবন দান করেন এবং তিনিই তা কেড়ে নেন।
# তারা বলতো, আমাদের বাপ-দাদাদের জীবিত করে আনো, এটা তারই জবাব। এতে বলা হচ্ছে, তা এখন হবে না এবং বিচ্ছিন্নভাবেও হবে না। বরং সব মানুষকে একত্রিত করার জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট আছে।
# অজ্ঞতা এবং চিন্তা ও দৃষ্টির সংকীর্ণতাই মানুষের আখেরাত অস্বীকৃতির মূল কারণ। তা না হলে প্রকৃতপক্ষে আখেরাত সংঘটিত হওয়া নয়, না হওয়াই বিবেক ও যুক্তি-বুদ্ধির পরিপন্থী।কোন ব্যক্তি যদি সঠিকভাবে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা ও নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা করে তাহলে সে আপনা থেকেই অনুভব করবে যে, আখেরাত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
# পূর্বাপর প্রসঙ্গ সামনে রেখে বিচার করলে আপনা থেকেই এ আয়াতের যে অর্থ প্রকাশ পায় তা হচ্ছে, যে আল্লাহ এই বিশাল বিশ্বজাহান শাসন করছেন তিনি যে মানুষদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন পুনরায় তাদেরকে সৃষ্টি করা তাঁর ক্ষমতার অসাধ্য মোটেই নয়।
# সেখানে হাশরের ময়দানের এবং আল্লাহর আদালতের এমন ভীতি সৃষ্টি হবে যে, বড় বড় অহংকারীদের অহংকারও উবে যাবে। সেখানে সবাই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নতজানু হবে।
# কলমের সাহায্যে কাগজের ওপর লেখানোই লিখিয়ে রাখার একমাত্র সম্ভব পদ্ধতি নয়। মানুষের কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করা এবং পুনরায় তা হুবহু পূর্বের মত করে উপস্থাপনের আরো কতিপয় পদ্ধতি এই পৃথিবীতে মানুষ নিজেই উদ্ভাবন করেছে। ভবিষ্যতে মানুষের করায়ত্ত হবে এরূপ আরো কী কী সম্ভাবনা আছে তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কী কী পন্থায় আল্লাহ মানুষের এক একটি কথা, তার তৎপরতার প্রতিটি জিনিস এবং তার নিয়ত, ইচ্ছা, কামানা-বাসনা ও ধ্যান-ধারণার প্রতিটি গোপন থেকে গোপনীয়তার বিষয় লিপিবদ্ধ করাচ্ছেন এবং কিভাবে তিনি প্রত্যেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং জাতির গোটা জীবনের সকল কর্মকাণ্ড অবিকল তার সামনে পেশ করবেন তা কার পক্ষে জানা সম্ভব?

Leave a Reply